বাংলাদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমকর্মীরা দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করতে আইন প্রণয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিরোধীদের ওপর ধরপাকড় এবং নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে নির্যাতনের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা ঘটছে এবং এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। ব্লগার, শিক্ষাবিদ, সমকামী অধিকার কর্মী, বিদেশী নাগরিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা নানা বঞ্চনার শিকার হলেও তাদের অধিকারের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব দাবি করা হয়েছে। ২০১৬ সালের বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট-২০১৭ নামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (ওইচআরডব্লিউ)। বৃহস্পতিবার সংগঠনটির ওয়েবসাইটে ও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। বাংলা ট্রিবিউন।
ওই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ব্লগার, শিক্ষাবিদ, সমকামী অধিকার কর্মী, বিদেশী নাগরিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কিছু হামলা হয়েছে। বেশিরভাগ হামলার ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হলেও বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ জঙ্গি গোষ্ঠীকে এর জন্য দায়ী করছে। এদের কারও কারও সঙ্গে বিরোধী রাজনীতিবিদদের সংযোগ রয়েছে বলেও দাবি করেছে সরকার। জঙ্গি সংগঠনগুলোর সন্দেহভাজন সদস্য কিংবা সমর্থকরা বিভিন্ন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং হাজারো মানুষকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ ইচ্ছে করেই বিরোধী দলের সদস্য ও সমর্থকদের পায়ে গুলী চালাচ্ছে। গুলীবিদ্ধরা অভিযোগ করে থাকেন যে, পুলিশি হেফাজতে তাদেরকে গুলী করা হয় এবং পুলিশ একে আত্মরক্ষামূলক উল্লেখ করে মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর অনেক সমর্থক ও সদস্য আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেককে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ কারাভোগ করছেন কিংবা গুম হয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। লেখক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা এবং অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করেছে। জুলাইয়ে হলি আর্টিজানে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনী বিধিবহির্ভূতভাবে অনেককে আটক করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হত্যা করেছে। প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকার বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিলেও এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়নের ব্যাপারে স্বচ্ছ তথ্য ছিল না। তাছাড়া মিডিয়াগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চলায় নিহত ও গ্রেফতারকৃতদের স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
এইচআরডব্লিউ’র ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, ২০১৬ সালে সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপরও সরকারি দমন-পীড়ন জোরালো হয়েছে। দুটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য বিশেষ আইন পাস করা হয়েছে। ওই আইনের আওতায় এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া বিদেশী তহবিল গ্রহণ নিয়ে এনজিওগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি আইন পাসের প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে হাজারিবাগ ট্যানারিতে কর্মরত শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, সেখানকার শ্রমিকরা প্রচ- রকমের বিষাক্ত ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করছেন। আশপাশের বস্তির বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, ট্যানারির কারণে সৃষ্ট দূষণে তারা নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। অথচ এ ব্যাপারে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে এইচআরডব্লিউ। ট্যানারিগুলোকে সাভারে সরিয়ে নিতে ২০০১ সালে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশও উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত বিদেশী শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার অভিযোগ করে আসছেন। এমনকি অনেকে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ারও অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। উপসাগরীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশী গৃহকর্মীদের জন্য বাংলাদেশ ন্যুনতম ২০০ ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছে। অথচ অন্য দেশ থেকে এসব দেশে পাঠানো গৃহকর্মীদের ন্যুনতম মজুরির মধ্যে এটি সর্বনিম্ন।
এইচআরডব্লিউর ৬৮৭ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে ৯০টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করে বলা হয়েছে, উগ্রবাদী সহিংসতার বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানো উচিত।
পাঠকের মতামত: